– এটা হয় কখন?
– আজ্ঞে, সকালের দিকেই বেশিরভাগ দিন ।
– স্মুদলি হয়? না বেশ বেগ পেতে হয়?
– আগে হতে চাইতো না বুঝলেন । বসে আছি তো আছিই । তারপর একেবারে হড়হড় করে ।
– এটা কতদিন ধরে হচ্ছে ?
– আজ্ঞে সঠিক কি আর বলতে পারব? তবে ওই বছর পনের ষোলো থেকেই বোধহয় ।
– তার মানে প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে হয়ে আসছে ।
সমুদ্রের ঢেউয়ের কোনো গাম্ভীর্য নেই । প্রগলভতা বেশি ভালো লাগে কিনা সেটা আমি বলতে পারব না । সমুদ্রের ধারে বসে থাকতে আমার ভালো লাগে । ঢেউয়ের উত্থানপতনে একটা সিম্ফনি আছে যেটা যে কেউই বুঝতে পারে বোধহয় । আমার কিন্তু পতনের অভিঘাত দেখেই সময় কাটে । ঠিক যে মুহূর্তে বালির পিঠে লেগে থাকা জলে মিশে যায় ঢেউয়ের উদ্ধত মাথা আমার রমলার কথা মনে পড়ে । সেও একই রকম উদাসীন রেগুলার ছিল । রণে, রমনে । বরাবর । রমলা আমার অভীষ্ট বান্ধবী ছিল না । তাকে আমি জোর করে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম একথা সম্পূর্ণ মিথ্যে নয় । অসম্পূর্ণ সত্য অবিশ্যি এটাই যে অসহযোগেও রমলা উচ্চকিত ছিল না ।
পুরুষের নখ-দাঁতে ভিক্ষা দেখতে পায়নি যে নারী তার বুদ্ধির প্রাচুর্যেও কোনো বৃদ্ধি হয় নি । সমুদ্রের গোপনীয় সূর্যের মতো । মেয়েদের বুঝতে পারা কিংবা না-পারা নিয়ে যে পৌরষিক অসংবদ্ধ স্তম্ভন তাতে আমার কোনো গ্রীষ্মকালীন বেদনা নেই । আমিও স্বভাবনিষ্ঠতায় হেঁটে আসি বালুচরে । মেঘ দেখি, পাখিদের নিঃসঙ্গ যাপন, মহিলাদের বিস্রস্ত আনন্দ, পুরুষের দম্ভ । আমার কোনো কাজ নেই ।
– কী কী ওষুধ খান আপনি?
– অনেক খাই – লাল, নীল, গোলাপি, লম্বা, বেঁটে, রাগী ।
– আমি ট্যাবলেট বা সিরাপ বলছি । রেগুলারলি কিছু খান?
– নাঃ । ডাক্তার দিয়েছিল কিছু । এক সপ্তাহ খেয়েছিলাম কিন্তু হজম করতে পারিনি ।
– কীসের ট্যাবলেট জানেন? ডাক্তারকে বলেছিলেন যে অসুবিধা হচ্ছে ?
– আমার শরীর আর আমি জানবো না? হার্টের । সুগার ও ছিল । ডাক্তারকে বলেছিলাম । পাত্তা দেয়নি ।
– অন্য ডাক্তার দেখাননি?
– না, সেও একই হতো ।
– তাই? তাহলে আমার কাছে এসেছেন কেন?
– বায়োস্কোপের লোভে ।
– মানে? এটা কি সিনেমা হল?
– আলবাত । আর আপনারা হচ্ছেন দুর্দান্ত সব ভিলেন । অবিশ্যি আপনি গলাধাক্কা দিচ্ছেন না যখন তখন আপনি তেমন জবরদস্ত ভিলেন নন ।
– হাহাহা । আপনার তো কোনো প্রব্লেম পাইনি এখনো । পেলেই গলাধাক্কা দেব ।
ঝাউ গাছের গুঁড়ির কাছে অল্প একটু বালি খুঁড়ে আমি বসে আছি । আমার ইচ্ছে ছিল এখানে এই গর্তের ভিতর আমি একটি জলাশয় করব । নিথর আনন্দে তার ওপর ছায়া পড়বে চাঁদের । জলাশয় বানাতে পারছি না আমি । আরও কতটা খুঁড়তে হবে সেটা জানি না । হাতের আঙ্গুল ছাড়া আমার আর কোনো অস্ত্র নেই । কতজনের কতকিছু থাকে । আমার পাড়ার বন্ধু পল্টুর আস্তিনে লুকোনো থাকতো ছোট একটা ছুরি । সে ছিল বাতিল নকশাল । কারণ তার আদর্শের ঘনত্বে পার্টি বিশ্বাস রাখেনি । আমি পল্টুকে হারিয়ে যেতে দেখেছি ।আমি তখন সকাল ৭ থেকে সন্ধে ৭ কারখানায় কাজ করি । প্লাস্টিকের বাটি বানাই, ঢাকা । আমার কোনো টাইম ছিল না পল্টুর পাশে থাকার । দগদগে জ্যোৎস্নায় আমি রেলপথে ফায়ার হয়ে গিয়েছি কতবার, বাঘাযতীন, যাদবপুর, গড়িয়ায় । আমি সেসময় মাথা নিচু করে হেঁটে যেতাম পুরোটা রাস্তা । সেকারণে, একমাত্র সেকারণেই আমি আমার পায়ের পাতা, আমার উপড়ে যাওয়া বুড়ো আঙুলের নখকে যতটা চিনেছিলাম সেভাবে আমার হাতের আঙুলদেরও চিনি নি । যে পায়ের পাতায় লাজুক হাসি লেগে থাকে তাকে আমি কতবার অনুসরণ করেছি । প্রেসিডেন্সি কলেজের ক্লাসমেট সুখময়ের বাবা – পুলিশের আমলা ছিলেন । বাড়িতে ডেকে নিয়ে মেঝেতে রাতুল চরণে হেঁটে গেলেন ভিতরঘরে আমিও ওনার প্রেমে পড়ে গেলাম । উনি আমাকে নিয়ে কলকাতার কত জায়গায় ঘুরেছেন – আস্তানা, ঠেক এমনকি ব্রিটিশ জাঙ্গিয়ার নিলামেও ।
লোকের সামনে স্নো-পাউডার মেখে দাঁড়াতে হওয়ার ভয়ে কতদিন আমি স্টেজে উঠিনি । আমার স্বপ্নের ঘোড়াগুলোর খুরের আওয়াজে পাতাদের ঝরে যাওয়ার সময় আমি কতবার ভুল করে ঘড়ি দেখতে চেয়েছি । সেবার পরিমল বলে বেপাড়ার ছেলে কারখানায় যাওয়ার সময় কলার চেপে ধরে ‘শালা তোমার ওই বন্ধুর জন্যই এই অঞ্চলে শ্রেণিসংগ্রাম দানা বাঁধছে না’। একথার কোনো উত্তর হয় না । আমি চিবুক বুকে ঠেকিয়ে রাখি । পরিমল অসহিষ্ণু হয় -‘তুমিও শেষমেশ চাকরি করলে?’ আমার বাবা আমাকে সাহেব বানাতে পারেনি আমি তাসত্ত্বেও কেরানি হতে হতেও শেষে কারখানার শ্রমিক হয়েছি । এতে আমার গ্লানি নেই কিন্তু প্রবল উন্মাদনাও ছিল না । ‘তুমি হইল্যা গিয়া সোনার টুকরো বেকার। প্রেসিডেন্সি করা হইসে আবার । ঠ্যাঙান খাওনের শখ’ বাবা রাতের দিকে একথা বলতেন প্রতিদিন, মা বলতেন ‘বড় হইসে, অরে অমন স্বরে কথা কইতে আসে?’ ‘রাহ দেইখ্যি’ বাবা ঝাঁঝিয়ে উঠতেন । আশা ছিল ছেলে বড়লোক হবে । ছেলে হল ছোটলোক । কিন্তু সেই স্বপ্ন – বাবা ও দেখতেন, তার বাবা ও, তস্য পিতা,তস্য ও । আমি আইন মেনে কবি হতে চাইনি । কিন্তু স্বপ্নে কবিদের প্রাণহীন চোখ কতবার ভেসেছে- শ্রদ্ধানন্দ পার্কে যখন পল্টুকে ফেলে রেখে গিয়েছিল ।
– আপনি আমার কাইন্ডলি কোয়াপারেট করুন মিঃ সরকার ।
– করছি তো, আপনার তেলতেলে টাক থেকে যে আলোটা ঘরে খেলে বেড়াচ্ছে তাতেও আমি চোখ বুজে নেই ।
– আপনি এতো সার্কাস্টিক কেন?
– না, আমি রিয়ালিস্টিক ।
– এর পরেও বলবেন আপনার কমিক সেন্স নেই? দিনের কোন সময়টা আপনার বেস্ট লাগে?
– চাবুক |
– চাবুক?
– ঘুমের ভেতর চালায় ওরা ।
– কারা?
– কারার ওই লৌহকপাট, ভেঙে ফেল কর লে লোপাট ।
– এই গানটা ভালো লাগে আপনার? আর কী শোনেন? রবীন্দ্রসংগীত?
– আপনি মাইরি ন্যাকা ।
– ঠিক বলেছেন, আপনি কী?
– নিম্নমধ্যবিত্ত । তাই জমাতে পারলাম না স্যার । আর রবিবাবুর গান আপনাদের জন্য স্যার । লেদ মেশিন দেখেছেন?
আমার এই বসে থাকাটা রমলা মেনে নিতে পারেনি কখনো । নারী মাত্রেই পুরুষকে কর্মব্যস্ত তৎপর দেখতে চায় । এটা নারীর দোষ নয়, পুরুষের অসহায়ত্ব কেবল । রমলা পার্টি করত । আমায় তো পার্ট দেয়নি কেউ কিন্তু পার্টি আমায় বৌ দিল । আসলে দেখলাম যে যার মতো সে সেইমতোই থেকে যায় । মধ্যিখানের এই পার্টি, রাজনীতি, মাও-সে-তুং বিচিত্র অভিনয়, অভিযান । রমলার মামা আমাদের পাড়ায় ভাড়া থাকতেন । মামাতো ভাইটি নিরুদ্দেশ হলো যখন তখন প্রথম রমলাকে দেখি । সে নাকি আমায় চিনতো । ‘আপনাকে বুঝতে পারিনা, পল্টুদাকে পারি । আপনি কনফিয়ুজড’ বলেছিল সে । আমি তার বুদ্ধির তারিফ না করে পারিনি । ‘কিন্তু আপনি তো ফোকাসড, আপনি মানেন যে কাজ আপনার পার্টির ছেলেরা করছে?’ আমার মৃদু আপত্তি ছিল হয়ত অভ্যন্তরে কোথাও । ‘আমার মানা দিয়ে কিছু যায় আসে না, আমাদের জোয়ান ছেলেগুলো মরছে খবর পান? আপনাদের বুর্জোয়া কাগজ লেখে সে কথা?’ আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি রমলার বিপন্ন মুখের দিকে । সে বলে চলে – ‘বাংলাদেশের ছেলেদের রক্ত এখনও লাল আছে, আপনি খবর রাখেন না । আমরা যদি সবাই মাত্র একটা করে মশাল জ্বালিয়ে নিই আপনার এই সমাজ একশোবার চিতায় জ্বলে উঠবে ।’ আমার ভয় হয় রমলাকে দেখে । আমার বাবার হার্টের অসুখ । আমার মায়ের বালগোপাল, স্নান, পুজো ।
– স্বপ্নে কী দেখেন?
– কে বললো দেখি? ইল্লি নাকি?
– দেখেন না বলতে চান?
– সেরকম না । আপনি মশাই খিটকেল । এই বয়সে স্বপ্ন জিজ্ঞেস করছেন ।
– বলুনই না ।
– আচ্ছা আপনার বয়স কত?
– কেন? হঠাৎ?এবার কি আপনি আমায় প্রশ্ন করবেন?
– ওয়াই নট । বিবাহিত?
– হ্যাঁ ।
– অন্য মেয়েছেলে আছে?
– এ আবার কী ধরণের কথা ।
– আপনি স্বপ্ন দেখেন?
– মাঝে সাঝে । কেন?
– সব সময়, বিভিন্ন বয়সেও একই ধরণের স্বপ্ন? বিয়ের আগেও যা পরেও তা?
– সার্টেনলি নট ।
– তাহলে? আমারও মদনের মতো একটাই স্বপ্ন থাকবে কেন? বৌ বেঁচে থাকতে একরকম, এখন মরে যাওয়ার পর …
– স্ত্রীকে স্বপ্নে দেখেন?
– হ্যাঁ । চিতার ওপর থেকে আমায় ডাকছে ।
– আর কাউকে দেখেন স্বপ্নে? প্রিয় কেউ ?
– বলব না ।
বুলু ছোটবেলায় আমার খুব ন্যাওটা ছিল । তবে তাকে ইন্সুলেট করে রাখা যায়নি । সময়ের নিয়মে তার মগজে তার বাবার বিরুদ্ধ কথা ঢোকানো হয়েছে স্বাভাবিকভাবেই । একাজ রমলা করেনি জ্ঞানত, সময় করেছে, পরিপার্শ্ব । বুলু বড় হতে হতে বুঝেছে তার বাবা সাহসী নয় । যার সাহস নেই তার সহচর হওয়ার সাধ্যও ক্ষীণ সেটা আমি জীবন দিয়ে বুঝেছি । ‘ভীতু মানুষ আমি দু-চক্ষে দেখতে পারিনা । কীসের এত ভয়?’ রমলা বলতো, বুলুর সামনেই । আমি চিবুক নামিয়েই শুনতাম, থেমে গেলে দেখতাম রমলা বেরিয়ে গিয়েছে ঘর থেকে । এরকম নিঃশব্দ সময়গুলোয় বুলু আমায় খুব মাপতো । আমার পায়ের কাছে এসে ছোট মুখ তুলে আমার নত মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে । যখন ছোট ছিল – ‘বাবা তুমি কাঁদছ? আমি মা-কে বকব খুব ।’ জীবনের নিয়মে হোস্টের প্রতি ইনফেকশন জীবাণুর কোনো সম্ভ্রম থাকে না, আমার প্রতি আমার ভয়েরও ছিল না । এই অশ্রদ্ধার জীবাণুটা খুব সংক্রামক ।
সমুদ্রের এ জায়গাটায় বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ি নির্জন । এখানে এসে বসলে চেনা লোক আসে না । চেনা জল আসে, ঢেউ কিংবা বালি । যে ঢেউ এক বছর আগে সমুদ্রের অপর উপকূল ঘুরে আসে তার নবউদ্ভাসিত আনন্দ সে ভাগ করে নেয় । ঢেউয়ের সন্তানেরা বাবা-মার্ সঙ্গে সঙ্গেই সমুদ্র পরিক্রমা শিখে যায়, ব্যর্থ হওয়ার ভয় থাকে না, হারিয়ে যাওয়ারও না ।
বুলুর যেবার নয় আমি ঠিক এইখানে এসে বসেছি, লিখছি কবিতা । আমার কাব্যগ্রন্থের জন্য আমি তখন গরিব উদগ্রীব । রমলা অনুযোগ করে বেড়াতে এসেও আমি সময় দিচ্ছি না তাদের, বুলু করে না । সে আমার মতো সমুদ্র ভালোবাসে । আমার চেয়ে ও বেশি । সেই বয়সেই সে বোঝে তাকে জিতে যেতে হবে, সে জিতে গেলে তার বাবাও হয়তো কোনো এক নিরুচ্চার যুদ্ধে জয় লাভ করবে । সে জেদ করে সাহসী হতে চায় । বুলু, বাবা আমার অত দূর যায়না, যেতে হয় না । সমুদ্রের ঢেউয়ে ঘোর লেগে থাকে । ঘর ও ।
– আপনি কবিতা লেখেন এখনো?
– আলবাত লিখি । কবিতা হারিয়েছে, হেরে গিয়েছেও ।
– একথা কেন বলছেন?
– কারণ সে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে আবার ।
– কবিতা লেখেন কেন?
– ওই যে বললাম । হড়হড় করে । হাগামোতার মতো । আপনি হাগেন কেন?
– বুঝলাম ।
– ঘোড়ার ডিম বুঝেছেন । বৌ থাকলে কবিতা বান্ধবীর মতো, বৌ মরে গেলে বৌ ।
– আপনার স্ত্রী তো অনেক বছর মারা গিয়েছেন, আর বিয়ে করলেন না ?
– কী হতো করে? তবে মেয়ে পেয়েছি, কবি তো!
– সমুদ্রে যান কেন এতো ঘন ঘন ।
– অপেক্ষা করি উপেক্ষার ।
– ছেলের কথা মনে আসে?
– ছেলেকে যখন হসপিটালে নিয়ে গেল অল্প জ্ঞান ছিল । সে শুধু তার মা-কে দেখতে চেয়েছিল । আমি সময় পাইনি বুঝলেন ডাক্তার । আমার সঙ্গে আমার ছেলে কথাই বলতে চায়নি । তার মা-কে বলেছিল ‘বাবাকে তুমি আর বোকো না মা’ ।
ঘরে গিয়ে বসতে হয় ডাক্তারের । কী অপেক্ষা । কত রুগী আসে । আমি আমার ময়লা ধুতির খুঁটটায় মুখ মুছি । বাকি যারা আসে তাদের অনেকের সঙ্গেই এখন আলাপ হয়ে গিয়েছে । রিসেপশনের মেয়েটি হাসিখুশি, প্রায় বাচ্চা । তার যার সঙ্গে ভাব আছে সে নাকি লেখক, আমার নাম সে জানে । আমি জানি একথা সত্যি না । কিন্তু আমি মেয়েটিকে দুঃখ দিতে চাইনি । আমার মনে হয়েছে সে ইচ্ছে করেই আমাকে খুশি করতে বলেছে । যেমন সে বাকিদের সঙ্গেও করে ।
আমি ডাক্তারের থেকে ছুটি নিতে এসেছি । সে খুঁজেছে । পায়নি । আমিও খুঁজেছি । হয়ত পেয়েছি । দূরে সমুদ্রে এখন প্রভাতী সূর্যের আলোয় সোনা হয়ে রয়েছে তট । লাল কাঁকড়ারা কি পরিশ্রমী । আমি শুয়ে থাকি যদি তারা আমায় পিঠে নিয়ে চলে যায় দূরে তাদের কোনো দেশে । ঝুঁকে পরে রমলা – ‘আমার ছেলেটাকে তুমি তাড়িয়ে দিলে ।’ আমি কঁকিয়ে উঠি ‘কী বলছ তুমি ।’ রমলা মুখ পাথর করে আনে – ‘তুমি পল্টুদাকে বাড়িতে থাকতে দাওনি । তোমার ভয় ছিল পুলিশ আসবে । তুমি আমার ছেলেটাকেও ।’ ‘তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে । আমি করিনি, আমি শুনতে পাইনি বিশ্বাস কর ।’ আমি ভেঙে যেতে থাকি । ‘তুমি শোনার চেষ্টা করোনি কোনোদিন । শুধু তোমার ভয়, তোমার চাকরি, তোমার কবিতা, তোমার বান্ধবীরা । তুমি বুলুকে মেরে ফেলেছ একথা তোমায় আজ স্বীকার করতে হবে ।’
আমি ছোট ঢেউগুলোকে আদর করতে থাকি । তারা আমার ধুতি পাঞ্জাবি ভেদ করে আমার রোমকূপে আলতো হাওয়া দেয় । ‘যা বাবা-কে ডেকে নিয়ে আয় ।’ তারা দূরে সরে যায় । আবার ফিরে আসে । আমি অপেক্ষা করি । একসময় তাদের বাবা আসে হাঁপাতে হাঁপাতে -‘ওদিকের অবস্থা আজ ঠান্ডা । জলে আজ খুব শীত । সূর্যের তেজ আজ কম, বৃষ্টি নামবে হয়তো ।’ আমি অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকাই । বিন্দু বিন্দু ঘাম তার জলজ শরীরে । সে চলে যায় – ‘আজ ভালো দিন । মন কে শান্ত করে নাও । ভয় নেই । আছি আমি, আমরা । চলে এস । কোনো দ্বিধা নেই ।’
আমি ভেসে উঠি ঘুম থেকে । অপলক জলের স্রোত । পেছন থেকে কারা যেন চেঁচিয়ে ওঠে – ‘ওই বুড়োবাবা’ । আমি পা চালাই । মাথাটা আজ নিচে রাখিনা মোটেই । ঢেউ বাড়তে থাকলে তাদের মাথার ওপর দিয়ে আমি বুলুকে দেখতে পাই । তার একটুকু বয়স বাড়েনি গত পঁচিশ বছরে । আজ একুশে ফেব্রুয়ারি । বুলুর জন্মদিন ।