Musings

মানবতাবাদী, নারীশিক্ষার অগ্রণী লীলা নাগ

Leela Roy

১লা জুলাই ১৯২১ । প্রায় একদশকের দাবিদাওয়া মেনে পূর্ববঙ্গে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্তন হয় ঢাকায় । শুধুমাত্র ছাত্রদের জন্য । সেই বছরেই কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে মেয়েদের মধ্যে স্নাতক পরীক্ষায় প্রথম (পদ্মাবতী স্বর্ণপদক) হয়ে নিজের বাড়ি ঢাকায় ফিরে আসেন লীলা নাগ । কিন্তু ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পড়বেন কোথায়? তদ্বির শুরু করলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য স্যার পি জে হার্টজের কাছে । উপাচার্য জানতেন না শিখাময়ী লীলার অপ্রতিরোধ্য দৃঢ়তার কথা । সেই বছরই আরও আগে কলকাতায় লীলার নেতৃত্বে ধর্মঘটে শামিল হয় বেথুন কলেজের ছাত্রীরা । অবমাননাকর মন্তব্যের জেরে অধ্যক্ষা মিসেস রাইটকে শেষমেশ দুঃখপ্রকাশ করতে হয় জনসমক্ষে । একইভাবে প্রথমে মেনে না নিলেও উপাচার্য হার্টজও অচিরেই লীলার অদম্য জেদের কাছে নতিস্বীকার করেন । সহশিক্ষার প্রবর্তন করে লীলা নাগই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা এম এ ।

কিন্তু, শুধুমাত্র রাষ্ট্রযন্ত্রের গঠনহীন বিরোধিতা লীলা করতে চাননি । সংগঠিত করতে চেয়েছিলেন এক জীবনবোধ যা প্রচারিত হয়ে উজ্জীবিত করেছিল সেই সময়ের অসংখ্য কিশোরী, মহিলাদের । তাই ১৯২৩ এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে আপাত স্বচ্ছন্দ জীবনের হাতছানি থাকলেও লীলা বেছে নেন এক অনশ্চিত ভবিষ্যৎ । দেশপ্রেমের শিক্ষা ও অনির্বাণ শিখা তাঁর অন্তরে প্রোজ্জ্বলিত ছিল, কিন্তু ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি অনুধাবন করেছিলেন লিঙ্গবৈষম্যের কুফল । ১৯২১এই কুমুদিনী বসুর সঙ্গে মিলে গঠন করেন “অল বেঙ্গল ভোটিং রাইট কমিটি ফর উইমেন” । মনে রাখতে হবে তার মাত্ৰ তিন বছর আগে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ত্রিশোর্ধ মহিলাদের নানা শর্ত মেনে ভোটাধিকার আইন পাস হয় এবং আরও দশ বছর লাগে একুশ বছরের ঊর্দ্ধে সমস্ত মহিলাদের ভোট দেওয়ার অধিকার প্রণয়নের। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯২০ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে মহিলারা পুরুষদের সমান ভোটের অধিকার এবং নাগরিকত্বের দায়িত্ব অর্জন করেন । সেই নিরিখেই লীলা – কুমুদিনীর এই প্রয়াস বিস্ময়ের উদ্রেক করে বৈকি ।

Leela Roy

নারীদের অবস্থা, পরিবার ও সমাজে তাদের নিম্ন মর্যাদা তাঁকে সর্বদা যন্ত্রণাবিদ্ধ করত এবং তিনি এর মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন আমাদের দেশে নারী শিক্ষার অভাব। তাই স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে প্রথমেই তিনি মেয়েদের জন্য একটি উচ্চ বিদ্যালয় চালু করেন। ততদিন অব্দি ঢাকা শহরে মাত্র একটি বালিকা বিদ্যালয় ছিল, সরকার কর্তৃক পরিচালিত। একই সঙ্গে তিনি “দীপালি সংঘ” নামে একটি নারী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন যা ঢাকার প্রথম নারী সংগঠন । এর কার্যক্রমের মধ্যে ছিল মেয়েদের জন্য কিছু উচ্চ ও প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, হস্তশিল্প কলা ও হস্তশিল্প শিক্ষার কেন্দ্র যা মেয়েদের অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা হলেও স্বাবলম্বী করবে, সামাজিক জনহিতকর কাজ এবং দীপালি প্রদর্শনীর আয়োজন করা যার মাধ্যমে নারীদের বৃহত্তর জাতীয় জীবনে আকৃষ্ট করা হবে। এছাড়াও “দীপালি সংঘ”-এ মেয়েদের আত্মরক্ষার জন্য মার্শাল আর্ট শেখানো হত । ঢাকায় “দীপালি সংঘ” প্রতিষ্ঠা করে চারটি স্কুল – “নিউ হাই স্কুল” বা “দীপালি স্কুল” (বর্তমানে “কামরুন্নেসা বালিকা মহাবিদ্যালয়”), “নারী শিক্ষা মন্দির” (বর্তমানে “শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়”), “শিক্ষাভবন”, “শিক্ষানিকেতন” এবং বারোটি বিনামূল্যের প্রাথমিক বিদ্যালয়। “দীপালি স্কুল” ঢাকায় মেয়েদের জন্য প্রথম ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল । “নারী শিক্ষা মন্দির” এক অর্থে পথিকৃৎ যেখানে প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, শিল্পকলা, সংগীত ইত্যাদি পৃথক বিভাগ ছিল । সঙ্গে একটি বিশেষ কোচিং ইউনিট যেখানে কিশোরী ছাত্রীরা এবং যে মহিলারা পড়াশোনায় আগ্রহী হয়েও ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি তাঁদের পড়ানো হত । সেই যুগেই “নারী শিক্ষা মন্দির”-এর একটি আবাসিক শাখাও ছিল। শহরতলী থেকে যে মেয়েরা পড়তে আসতেন “নারী শিক্ষা মন্দির”-এ এবং বাইরে থেকে কাজের সূত্রে আসা মহিলাদের সেখানে থাকার অনুমতি দেওয়া হত ।

যে পার্থক্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থার কথা আমরা কল্পনা করছি আজ সেটা লীলা নাগ প্রচলন করেছেন আজ থেকে প্রায় ৯৫ বছর আগে । ১৯২৬-২৭ র নারী শিক্ষা মন্দিরের বার্ষিক অধিবেশনে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি ব্যক্ত করেন – “সবাই স্বীকার করবেন যে জীবনের বিভিন্ন স্তরের মহিলাদের জন্য একই সিলেবাস উপযুক্ত নয় । বাংলায় এমন একটি প্রতিষ্ঠানও নেই যেখানে প্রতিটি মেয়ে কিছু না কিছু শিখতে পারে। এমন কোন প্রতিষ্ঠানও আছে কিনা আমরা জানি না যেখানে বয়স্ক মহিলা এবং বিবাহিত মহিলাদের কিছু শেখানো হয়। সাধারণ উচ্চবিদ্যালয় শিক্ষা বয়স্ক বা বিবাহিত মহিলাদের জন্য উপযুক্ত নয়। আমরা এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেছি এই দৃষ্টিভঙ্গি মাথায় রেখে। এখানে আমরা তাদের ইতিহাস, ভূগোল, পাটিগণিত শেখানোর চেষ্টা করছি, স্বাস্থ্যবিধি, সেলাই এবং শিল্প ও কারুশিল্পের পাশাপাশি।” আরেকটু এগিয়ে গিয়ে সেই একই বক্তৃতায় ২৬-২৭র লীলা নাগ বলেন -“বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করে যে সত্যিকারের শিক্ষাই একটি মেয়েকে আদর্শ মা হতে সাহায্য করে। এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির কোন যুক্তিযুক্ততা বা কোন মূল্য নেই। যদি শিক্ষার লক্ষ্য হল মানুষের সুপ্ত অভ্যন্তরীণ শক্তি বৃদ্ধি করা, তাহলে আর প্রয়োজন নেই একজন মেয়েকে মা, মেয়ে, স্ত্রী বা বোন হিসাবে তার কর্তব্য সম্পর্কে আলাদাভাবে শেখান ।”

Leela Roy Letter

বিস্মৃতিপ্রিয় বাঙালি যেটুকু লীলা নাগকে মনে রাখার চেষ্টা করেছে তা মূলত নেতাজি সুভাষ চন্দ্রের অনুগামিনী হিসেবে । হয়তো কিছুটা তাঁর সৃষ্ট ‘জয়শ্রী’ পত্রিকার জন্যও যেটা ১৯৩১ থেকে অদ্যাবধি প্রকাশিত হচ্ছে , এখন অন্য কারো সম্পাদনায় । এই পত্রিকার আশীর্বাণী লিখে দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নিয়মিত লেখকের মধ্যে অনেকেই ভব্যিষ্যতে প্রথিতযশা চিন্তক, সাহিত্যিক হয়েছেন । ১৯৩০ থেকেই নিয়মিত সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠেনের সঙ্গে লীলা নাগের সংস্পর্শ বেড়ে যায় । হ্যান্ড-গ্রেনেড ব্যবহারের গোপন প্রশিক্ষণ নিয়মিত ছিল লীলার দীপালি সংঘে । সেখানেই তাঁর কাছে তালিম নিয়ে প্রীতিলতা ওদেদার যোগ দেন মাস্টারদা সূর্য সেনের দলে । ১৯৩১এই রেণু সেনের সঙ্গে জেল খাটেন লীলা – প্রথম ভারতীয় মহিলা রাজবন্দী হিসেবে । ১৯৪৬-এ নোয়াখালী ও কলকাতার দাঙ্গা শুরু হলে লীলা দুস্থদের সেবা ও সাহায্য করতে ছুটে আসেন। নোয়াখালীতে গান্ধীজি পৌঁছানোর আগেই, লীলা “ন্যাশনাল সার্ভিস ইনস্টিটিউট” নামে একটি ত্রাণ কেন্দ্র খুলে ১৭টি ক্যাম্প সংগঠিত করেন । মাত্র ৬ দিনের মধ্যে ৯০মাইল পায়ে হেঁটে ৪০০জন মহিলাকে উদ্ধার করেন লীলা ও তাঁর অনুগামীরা । সেই বছরই তিনি গণপরিষদের সদস্য (“মেম্বার অফ কনষ্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি”) নির্বাচিত হন । ততদিনে কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে তার বিভেদ ক্রমশঃ প্রসারিত হতে থেকেছে । লীলা দেশভাগের বিরোধিতা করে গণপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং “পূর্ববঙ্গ সংখ্যালঘু কল্যাণ কেন্দ্রীয় কমিটি” গঠন করে তাঁর ত্রাণ ও উদ্ধার কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন ।

আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে লীলাবতী নাগ বুঝেছিলেন শিক্ষার ভিতর দিয়েই নারী অবস্থানের উন্নতিসাধনের কথা । বুঝেছিলেন প্রথাগত পড়াশোনার পাশাপাশি কারিগরি, বৃত্তিমূলক শিক্ষা মেয়েদের স্বাধিকারের পথ সুগম করবে । তাই কেবলমাত্র দুইয়ের দশকের কর্মকান্ডই নয়, এমনকি ১৯৪৬এও প্রতিষ্ঠা করেন “জাতীয় মহিলা সংহতি”। তার নতুন উদ্যোগে কর্মজীবী ​​মেয়েদের জন্য “সংহতিশ্রী” নামের একটি আবাসিক বাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৫৫ সালে এবং “বিজয়া” নাম দিয়ে বসিরহাটে একটি মেয়েদের হোস্টেল খোলেন ১৯৬৪তেও।

কেন্দ্র সরকার পার্লামেন্টের কেন্দ্রীয় হলে তাঁর একটি প্রতিকৃতি রেখেই তার কাজ সেরেছেন। আজকাল মানবীচেতনার নানা সংগঠন হয়েছে, কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পাঠ চলে । এর পাশাপাশি স্বাধীনতার ৭৫পূর্তি উপলক্ষে হাজারো একটা অনুষ্ঠান, বই, লেখা বেরোচ্ছে । স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং নারীশিক্ষার মাধ্যমে নারীউন্নতি – এই দুই কর্মকান্ড যাঁর ভিতর সমান্তরালে নিরলস বয়ে চলেছিল, কী আশ্চর্যভাবে তাঁর নামটিই কোথাও উল্লেখ হতে দেখি না । যে জাতির জন্য তিনি তাঁর সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তারাই তাঁকে দুঃখজনকভাবে সবচেয়ে বেশি ভুলে গিয়েছে ।

উজ্জ্বল মানবতাবাদী অদম্য চেতনার অপর নাম – লীলা নাগ ।