A book of revelation … Max von Sydow in The Seventh Seal.
Photograph: Moviestore/Rex/Shutterstock/The Guardian
প্রেসিডেন্সি কলেজের অন্ধকার ডিরোজিও হলের উঁচু দেয়ালগুলো ঝুঁকে পড়েছে, শ্বাস ফেলছে কাঁধের ওপর আর রুক্ষ, ধূসর প্রান্তর ঠেলে হেঁটে
আসছি আমি কোন যুগের ওপার থেকে । খসে পড়েছে অঙ্গরাখা, নিঝুম হয়ে আসছে চোখ, পাশের বন্ধুর অবয়বও দেখা যাচ্ছেনা এতো তীব্র হাহাকার, মনে আনতে পারছি না কোনো প্রিয় মুখ । এরপর ধীর পায়ে শ্রদ্ধানন্দ পার্ক ঘুরে, অপেক্ষা করতে হয়, বাস যায়, মাস যায়, আকাশের নক্ষত্রও । কেউ পালাতে পারেনা, কিছু রয়ে যায়নি অনাঘ্রাত । ক্লান্ত লাগে, অসময়ের বেহিসাবি বিলাসিতায় আপন সংস্রব খননের জাল বোনে । মহামারী শূন্য করে দেয় জনপদ, শূন্য হয়ে যায় অভিলাষ, গোপনীয় সংগ্রাম, সংঘাত, বালখিল্য আঁখিপাতে করুণ অশ্রুঋণ ।
ঝড় নেই, কোনো প্রগাঢ় ঝঞ্ঝার আবেগ ।
ডন কিয়োতের মতো, সঙ্গে সেই পরিচিত ভাঁড় – কী অসম্ভব দীর্ঘ ছায়া পড়ে কারো কারো, কখনো কচিৎ ঘুমোতে যাওয়ারও আগে । শব্দেরা কম কথা বলে । প্রয়োজনে মূক, মুখের ব্যঞ্জনাময় দাগগুলো ধরে রাখে বৃষ্টির ধারাজল, গোপন আল – পাহাড়ের নদী জানে কখনো সখনো ।
অন্ধকারে আলো, তেরছা, লজ্জাবনত ।
ম্যাজিকের আড়ালে ঈশ্বর । দঁড়িয়ে থাকেন বিজ্ঞান ও হৃদয়ের সন্ধিতে । অথচ বিপুল আয়োজনে পড়া হয় ফিজিষ্কের অঙ্ক, সামাজিক জ্ঞানও ।
সময় এভাবেই থমকে থাকে কখনো । এভাবেই হাতের তালুর ওপর অসহায় শুয়ে থাকে রেখাদের জঙ্গল । এবারেও কথা হয় না । খুলে ফেলে একে একে মুখোশের ভিড়ে হারিয়ে যায় দৃষ্টির নির্মেঘ স্থিতি । গোধূলির ছায়া নেমে এলে অযথা ভয়ের বীজ মৃত্যু হয়ে আসে । ঘৃণা হয় তাদের প্রেত, হাত, বয়সী করুণার প্রতি, ভয়ও হয়, অকস্মাৎ মিছিলের মত ঘিরে ধরে আচমকা । কত দূরে চোখ গেলে, ফেরাবে না আলো? কখনো শৈশব, কখনো ক্ষুরধার দুপুরের সংঘবদ্ধ তেজ । কারণ ম্যাজিকের ঘরেই ধেয়ে আসে নারী । যৌন মরীচিকা, সংবেদ অসীম । ম্যাজিকের আলোয় সীমানাজুড়ে বিক্ষোভ দেখা যায়, কেউ কেউ মেনে নেয়, কেউ ভাবে কোনোকিছু সত্য নয় ।
আলো ভাঙে, যেভাবে গাছের শিরার ভিতর শতাব্দীর ক্রোধ ভেঙে পড়ে নিজের ছায়ায় । সারল্যের পতন হবে জেনেও বিশ্বাসের অহমিকা থাকে । যে কিশোরী স্তব্ধ হয় এক পর্দার আড়ালে সেই পরে ফুটে ওঠে সারাব্যান্ড মূর্চ্ছনায় । প্রখর প্রান্তরের গৈরিক কাঠিন্যের পাশেই শীতের
কৌমুদী রহস্যলোক । তার আর কোনো বীরগাথা নেই । চোখের ভিতর দিয়ে মনের গভীর সেই পড়ে ফেলতে পারে, তাই সে চোখ তুলে কোনো
দীঘি মাপতে যায় না আর । লাজুক সংবেদনে সে নিশ্চুপ থাকে মমতায় । বীরব্রতির মতো সেও তো অসহায়, ঈশ্বরের সামনে বসে থেকেও সে উদাসী, অবিশ্বাস-বিশ্বাসের মধ্যবর্তী এক সংশয়দীর্ণ জলাশয় ।
ম্যাক্স ভন সিডো । এমন এক বিস্মিত বিশ্বাসের নাম যার হাত ধরে হেঁটে যাওয়া যায় 'সেভেন্থ সিল' থেকে 'ম্যাজিশিয়ান' হয়ে 'ভার্জিন স্প্রিং' থেকে 'উইন্টার লাইট'এ । 'ভার্জিন স্প্রিং'এর শেষ দৃশ্যে ঝর্ণার সামনে বেঁকেচুরে ধসে পড়ায় ভেঙে পড়ে মানবিক দেওয়াল । এ কোনো একক ব্যক্তির জ্যামিতিক সংকেত নয় । মার্চেলো মাস্ত্রিওয়ানির সুপুরুষ যৌনাকর্ষণ তাঁর নেই, মিফুনের দেহ ঘিরে প্রকৃতির উদ্দাম আশ্লেষও । সিডো তাঁর অবকাশে মিতবাক, তবু কী গভীর পরিণয়প্রকাশ যদিও প্রবীনকালে বার্গম্যানের ভরসায় থাকেন এর্লান্ড জোসেফসন । হয়তো কিছুটা তাকাশি শিমুরা, 'ইকিরু'য় যাকে দেখে এখনো মথিত হয় অপেক্ষার চর ।
কত মুখ বার্গম্যান নিয়ে আসেন দর্পণে । বিশ্বাসের মর্মান্তিক ভার নিয়ে জ্ঞানান্বেষণে হতোদ্যম এমন আবেগায়িত মুখশ্রীর দিগন্তে বার্গম্যান
এঁকে চলেন মনের জটিল অভিযোজন । তাই তিনি নিজেই গরল টেনে বসে যান মৃত্যুর সঙ্গে দাবাখেলায়, যে খেলায় কোনো জয়ের আশ্বাস নেই, থাকে শুধু মৃত্যুকে প্রলম্বিত করার মানুষিক প্রয়াস । কোনো গভীর ব্যক্তিগত বেদনার উপলব্ধি থেকেই হয়তো সিনেমার পর সিনেমায় ঈশ্বরের কাছে প্রশ্নেরা থেকে যায় সারিবদ্ধ পিঁপড়ের অবিচ্ছেদ্য চলনের মতো । যেভাবে কোথাও বিশ্বাসের অপর রূপ নিয়ে মায়াময় কৌমার্যে সত্যজিৎ এঁকে রাখেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মুখাবয়ব ।
'দ্যা গ্রেটেস্ট স্টোরি এভার টোল্ড'এর শেষে সিডো নিজেই হয়ে যান ঈশ্বর, আর পরে 'এক্সোরসিস্ট'এ শয়তানকে পড়ে নেন চোখের পাতার মতো । এতোদিনে মৃত্যুর ছায়া হয়ে ঈশ্বরের দিকে অপাঙ্গে তির্যক থেকে তাঁকেই শুষে নেন চামড়ার প্রচ্ছন্ন আশ্রয়ে ।
বাস যায়, মাস যায়, নক্ষত্রের আকাশ পাল্টে নেয় দ্রাঘিমা । উপদ্রুত মন নিয়ে অপেক্ষায় থাকতে হয় অকরুণ জ্যোৎস্নায় । সিনেমারা শেষ হয়
একসময় । একে একে বেরিয়ে পড়ে তারা । খুঁজে চলে মানুষের গন্ধওয়ালা দু- চারটে জঙ্গম মাস । জনপদ খুলে রাখা হৃদয়ের বাতিঘরে, দীর্ঘ অন্ধকার হানা মারে । নাইট তাঁর প্রিয় ঘোড়া চড়ে ঘিরে থাকেন চেতনা, প্রবল বিকেল থেকে সন্ধে চুরি করে ঝড় আসে । মধ্যযুগীয় ইউরোপের মহামারী স্তব্ধতা এখন আরও বেশি নিদারুণ সত্য, শিল্পের মায়াবী রামধনু হারিয়ে যেতে থাকে, কোকিলের পরিত্রাহি আর্তনাদে । তবু, ফিরে দেখা স্মৃতিদের পাশে নবীন গাম্ভীর্য নিয়ে সিডো কখনোবা রাশপুতিনের মতো বিস্ময়কর অণির্ণয় কখনো সুস্থিত চুম্বক । রাজকীয় হয়েও সাধারণ, সামান্যের মধ্যেও অপরিসীম, বার্গম্যানের মুখ না মুখশ্রী তা প্রায় অযৌক্তিক তর্ক ।
কিছু কিছু স্টপেজে কখনো কেউই থাকে না । তাও জীবন ঘড়ির কাঁটার নিয়মে স্তব্ধ হয়, নম্রও, কপালের চুলগুলো হাওয়ায় বিস্রস্তকালে চোখে চোখ রাখে মহাকাল । মৃত্যুর প্রায় একমাস পরেও তাই ম্যাক্স ভন সিডো এক অবিশ্বাসী বিশ্বাসের নাম | বন্ধু কি? সহচর? বোধহয়, আপন পদস্পর্শরহিত ছায়ার মতো এক অপার পরিমিতিবোধ, নক্ষত্রের নিভে যাওয়ার আগের শেষ চৈতালি রাতের মায়াময় স্বপ্ন ||