যমজ যমজ
রুবীকে প্রথম দেখি ‘ব্যাটারড মাইন্ডস’দের একটা ওয়ার্কশপে। সে সময় বোধহয় রুবী রেগুলার কলকাতা আসত ট্রেন করে। গ্রামাঞ্চলের মহিলাদের দুর্গতি ছিল বিষয়। শুরু করেছিলাম – “স্যানিটেশনের কথা কেউ ভাবে না। অন্য অসুবিধা বাদ দিলেও রাতের বেলা ঝোপে ঝাড়ে সাপের ভয়ও থাকে। আমার মনে হয় কিছু পার্মানেন্ট টয়লেটের পরিকল্পনা করা উচিৎ আমাদের।” ওয়ার্কিং কমিটির অনুমোদন যখন প্রায় পেয়েই গেলাম, কালো মেয়েটা হঠাৎই আমায় প্রশ্ন করল – “আপনি কটা গ্রামে গেছেন দিদি? পাকা পায়খানা না থাকলে আমাদের সমস্যা হয় ঠিকই, তার চেয়েও সমস্যা হয় জ্বালানি সারা বছরের জন্য শুকনো রাখতে। আপনারা পাকা পায়খানা করে দেবেন – আমরা তাতে কাঠ রাখব, কারণ ওটাই আমাদের বেশী দরকার।” এটুকুই মুখ তুলে এক নিঃশ্বাসে বলেছিল সে। হলভর্তি লোকের সামনে। তার বলার মধ্যে একটা দৃঢ়তা ছিল, কেমন ভয় পেয়ে গেলাম। “কী কর তুমি? থাক কোথায়?” তখনই জেনেছিলাম রুবীর বাড়ি ক্যানিং, বর নেয় না, অন্য মেয়ের সাথে থাকে। রুবী একাই থাকে, আয়ার কাজ করে। “আমার বাড়ি যাবে? আমার বাড়িতে অনেক বাচ্চা আসে – পড়তে, খেলতে, তাদের দেখতে হবে আমার সাথে, আসবে?”
সেই থেকে রুবী আমার বাড়ির একজন।
এটুকু দেখার পর পর্দা সাদা হয়ে যায়। না, কোনো শিক্ষামূলক সরকারী অনুগল্প হয় না এটা, কিন্তু ফেড-ইন এ দেখা যায় কলকাতা দক্ষিণ শহরতলীর একতলা বাড়ির বারান্দা। একটি মেয়ে ক্যামেরার দিকে পিঠ করে। তার মুখোমখি এক যুবক।
– তোমাকে অনেকদিন বলেছি আসবে না, আমার ভাল লাগে না।
– কেন? তুই আমার বৌ – সবাই সাক্ষী আছে। অমন ছেড়ে দেব কেন তোকে?
– এখন বৌ? আর সে মেয়েটার কী হল? তাড়িয়ে দিল নাকি?
– মুখ সামলে কথা বলবি।
– তাই? তুমি যা কিছু করে বেড়াবে আর আমায় তোমার বাড়িতে পিদিম জ্বেলে বসে থাকতে হবে, কেন শুনি?
এই সময় লোকটা মেয়েটার হাত খপ করে ধরে ফেলে আর মুচড়ে দেয় –
– আঃ লাগে। এই তো পারবে। মদ খাবে আর পেটাবে। ভাত দেওয়ার ভাতার নয়, কিল দেওয়ার গোঁসাই।
– তুই ফেরত যাবি কিনা বল।
– না যাবো না। আর এখানে চিল্লিও না, দিদি রাগ করবে।
– চুপ কর, দিদি – হুঃ, দেখা আছে ওসব। বেশী পেঁয়াজী কল্লে দোব ঢুকিয়ে, শাল্লা।
আমার সবসময়ই মনে হত সমীর আমায় সেভাবে ভালবাসতে পারছে না – হয়ত ডিভোর্সি বলেই। কালীঘাটে এনজিও টায় কাজ করার সময় আলাপ — ও পাড়াতেই। কে জানে। হয়ত আমাকেও সেরকমই ভাবত সমীর। ও যেদিন শুতে চেয়েছিল প্রথম, আমি আপত্তি করিনি – দেহ আর মন তো পৃথক নয়। সমীর বোধহয় ভেবেছিল আমি রাজি হব না – ও কিছুই করে উঠতে পারল না। গম্ভীরভাবে সিগারেট খাচ্ছিল যখন আমি তখনও জামা পরিনি, অপমানিত লেগেছিল খুব – ডিভোর্সি মানেই এ্যাভেলেবল ভেবেছিল কি সমীর? ওর সিগারেটের জমে থাকা ছাইতে সে কথাই বলা ছিল।
স্থানঃ ঘরের ভিতর। সময়ঃ সন্ধ্যা। ঘরে একটা আলো। রুবী ও নীলা বসে আছে দেখা যায়।
রুবীঃ দিদি তুমি যে জামাগুলো আজ নিয়ে গেলে বাচ্চাগুলোর হবে তো?
নীলাঃ হ্যাঁ, তা হবে। কেন তোমার সন্দেহ ছিল নাকি? তবে অনেক একসাথে কিনলে দাম কম হয় বলেই কেনা, না হ’লে কামিজগুলোর যা রঙ।
রুবীঃ আরে ওরা তো এসব রঙই পছন্দ করে।
নীলাঃ তোমার স্বামীর সঙ্গে রাস্তায় দেখা হল। আমায় হাসি হাসি মুখে ভয় দেখাবার চেষ্টা করল।
ফ্যানের স্পীড বাড়িয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল নীলা।
নীলাঃ আমায় বলল আমি নাকি বাড়ি থেকে মেয়েদের ভুলিয়ে নিয়ে আসছি। আরো অনেক কথা। যাই হোক, কাল সকালে ঢাকুরিয়া আওয়ার কথা মনে আছে তো?
রুবীঃ আছে দিদি। সব প্যাকেট করে রেখেছি। তুমি ওর কথায় পাত্তা দিও না। ঢোঁড়া সাপ সব।
স্কুলে পড়ার সময় এক একটা পুজোয় আমার ভালবাসা কাটত এক একজনকে নিয়ে। মনে হত একটা দিন এবার একেই সব থেকে ভালবাসব – মা, বাবা, দিদি, বড়মাসি, নন্দা দিদি, আরও অনেকে। এরা ঘুরে ফিরে আসত। কখনও কখনও নতুন কেউ – যেমন প্রসূনদা। দিদি তো সারা বছর ভালবাসত। আমি শুধু পুজোর চারদিন চেয়েছিলাম। দিদি খুব মেরেছিল, দাদুর লাঠি দিয়ে, এখনও পিঠে দাগ আছে। বিয়ের পর অভীক ওই দাগে হাত বুলোত, আদর করত, আমি কুঁকড়ে যেতাম। ভালোবাসা অপরাধ – সে কথা মনে পড়ে যেত তখন। মঙ্কা হওয়ার দিন রাতে প্রসূনদা আমার বুকে হাত দিয়েছিল – আমার মনে হয়েছিল দিদি এই লোকটাকে বিয়ে করল কী ক’রে, সে একবারও চুমু খেতে চায়নি!
প্রসূনদাকে আর কোনোদিন কাছে আসতে দিইনি, পিঠের দাগটাকে সেই থেকে ইগনোর করতে পারলাম। দিদি জানে না এখনও, মঙ্কা হওয়ার পর ওর প্রসূন আমাকে কামনা করেছিল।
– দেখুন দিদি, আপনাদের অনেক বাতেলা শুনেছি, বেশ্যাবাড়ির বাচ্চাদের পড়ানো, ফড়ানো।
– রাস্তা ছাড়ো, আমার কাজ আছে।
– জানি তো কী কাজ। বাইরে সব লোক দেখানো, আর নিজের ঘরে মেয়ে বসাচ্ছো। লোক আসে যায়, জানি না নাকি?
– ভুল জানো। কিন্তু তোমার সঙ্গে তর্ক করার মতো সময় বা ইচ্ছে আমার নেই।
– একদিন সবকটাকে টেনে রাস্তায় নামাব। দেখব কার কত ক্যাপা।
– ঠিক আছে দেখো, এখন ছাড়ো, আমার দেরী হয়ে গেছে।
মিডশটে দেখা যায় একটা বাসস্টপে নীলা দাঁড়িয়ে আছে অফ হোয়াইট তাঁতের শাড়িতে শহরের সেপিয়া টোন মিশে যেতে শুরু হ’লে হাল্কা ব্যাকগ্রাউন্ডে শোনা যায় –
“ভালো কইরা বাজাও গো দোতারা
সুন্দরী কমলা নাচে”
আস্তে আস্তে সব মিলিয়ে যায় – পড়ে থাকে শূন্যতা।
টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো ছড়িয়ে আছে ভবানীপুরের বাড়িতে। তাই ওখানে আর থাকি না। বাবা-মা দুজনেই চলে গেলেন ও বাড়ি থেকেই। দিদি এখন ধানবাদে। বাড়িতে তালা। “একা একা নতুন জায়গায় বাড়ি ভাড়া নিবি কেন আবার?” দিদি বলেছিল, হয়ত ভাল ভেবেই।
মাঝেমাঝে মনে হয়, আমি কি তবে পালিয়ে বেড়াচ্ছি? জানলা দরজা একে একে সব বন্ধ করে দিয়েছি। তবু দুঃখ হামলা চালিয়ে যায়, আমার প্রবলেমটা কী তবে? বিয়েটা টিকল না, প্রেমটাও। প্রথমটায় বাঁজা শুনতে হল, দ্বিতীয়বার আমার অসাবধানতায় লজ্জা পেল সমীর। অ্যাবর্ট আমিই নিয়েছিলাম একা। অনেকক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করেছিল ডাক্তার – আমার পদ্মযোনিতে।
– রুবী তোমার বাচ্চা হয়নি না চাওনি?
– চাইব না কেন দিদি? চেয়েছিলাম খুবই। কিন্তু হল না কেন কে জানে। আর ও তো বিয়ের বছরখানেকের মধ্যেই অন্য মেয়ের সঙ্গে থাকত।
– তোমায় মদ খেয়ে মারত এতো, তারপরেও ছিলে কেন ওখানে?
– আমাদের সব বাড়ির ছেলেরা তো বৌকে বিনা কারণেই পেটায়। তুমি হাসালে দিদি। না পেটালেই তো বন্ধুরা ছি ছি করবে। আর যাবো কোথায় বল? ঘরে একটা নেকড়ে, বাইরে তো দশটা। স্বামী নেয় না মেয়েদের তো এটাই অদিষ্ট।
– আরেকটা অন্য লোকের সাথে তো তুমিও থাকতে পারতে?
– নাহ, সে একই হত। এই বেশ আছি, ঝুট ঝামেলা নেই। তুমি বিয়ে করলে না কেন দিদি?
– শ্বশুর বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি আসার পর আর হয়ে উঠল না আবার। নিজের মতো একা থাকি। সেইটাই তো ভাল। তবে মনে হয় একটা বাচ্চা থাকলে ভাল হত – নিজের। যেটা এসেছিল সেটা থাকলে প্রায় দশ বছর হত।
– তুমি তো বাচ্চাদের নিয়েই কাজ কর দিদি। তোমার বাচ্চা তো এরা সবাই। তোমায় কত ভালোবাসে বলো তো।
– হ্যাঁ জানি। কিন্তু কোথায় যেন জবাব দেওয়ার থাকে। কাকে জানি না, হয়ত নিজেকেই। এতগুলো বছর তো চলে গেল অন্যের মত করে নিজেকে তৈরী করতে। নিজের কী ভাল লাগে, কী চাই, সে তো এতোদিনে ভাবি।
– তোমার কথা সব বুঝি না দিদ। কিন্তু আমারও মনে হয়, অদি একটা মেয়ে থাকত, কী ভাল হত। তারপরেই ভাবি, মেয়ে হবে কী করে? বিয়ের কথা ভাবলেই মন বিষিয়ে যায়।
মন্তাজে দেখা যায় একটি ছোট মেয়ে তার দাদার সঙ্গে মাছ ধরতে যাচ্ছে, দাদা সারাদিন একটা মাছও ধরতে পারেনি। ফেরার সময় ম্লানমুখে সূর্য অস্ত গেলে বোন দাদার হাত ধরে বলেছিল – “দুঃখ পাস না দাদা, চল, পুকুরে শালুক তুমি”। দাদা প্রথমে নেমেছিল পুকুরে – ভর্তি শালুক, ক্যালেন্ডারের ছবির মতো – “বোন, কেটে ফেলল, বাঁচা” – দাদা চিৎকার করেছিল। জলে সাপ ছিল, অন্ধকারে ঠাহর হয়নি। রাত পেরোয়নি।
রুবী কোনোদিন ছেলে চায়নি মন থেকে। দাদা ছিল, আছে – এখনও।