- ১
রাত ১১-০৫। অফিসের গাড়িটা লাস্ট মোমেন্টে জানা গেল খারাপ হয়েছে । অতএব নেক্সট শাটল পেতে রাত ১২। কাল নীলের জন্মদিন । রাত ১২য় ওকে উইশ করবে এমনটাই প্ল্যান করেছিল সুগতা । ছেলে এবার ৬।এখন একটু বুঝতে শিখেছে – আবদার করতে ও। হলু্দ ট্যাক্সি গাড়ি চাই তার। অফিসের মাঝে লাঞ্চ টাইমে বেরিয়ে সেই গাড়ি কিনেছে সুগতা। কাল ছুটি নিয়ে ছেলের সাথে সারাদিন কাটাতে পারবে না এই গিল্ট কনসেন্স থেকে আরো একটা গাড়ি। ‘আজ অফিস যেও না মা’ যখন বলে নীল কোথায় যেন খারাপ লাগে সুগতার, ভাবে চাকরীটা ছেড়ে দেবে, কিন্তু পারে না। তার স্কুল-মাস্টার মায়ের ও খারাপ লাগত তাকে ছেড়ে যেতে এই ভেবে সান্ত্বনা খুঁজেছে সুগতা । ‘দ্যাখো, ফিরতে পারো কিনা ১২ র আগে’, খোঁচা দিয়েছিল অনিমেষ, সুগতার কর্পোরেট স্বামী, ঝাঁঝালো।অতএব আর ওয়েট করা যাবে না কোনমতেই। সুগতা লিফট বেয়ে নেমে আসে রাস্তায়। শহরের এই দিকটা, ইলেকট্রনিক কমপ্লেক্স রাতে ফাঁকা হয়ে যায় । উঁচু উঁচু বাড়িগুলো তখন মাথা নামিয়ে জরিপ করে রাস্তার খুদে হয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে । মানুষগুলো বেশিরভাগই কর্পোরেট – নিথর অন্ধকার বুকে নিয়ে চলে ।
- ২
বাইপাসের থেকে নেমে একটা ছোট রাস্তার ধার ঘেঁষে মন্টু ট্যাক্সিকে দাঁড় করায় । বাইপাসে দাঁড় করালে পুলিশ বড্ড ঝামেলা করে। মন্টু মণ্ডল, ৪৫। বাড়ি মেমারি। কলকাতায় ভবানীপুরে থাকে, ট্যাক্সি-মালিকের গ্যারেজেই রাত কাটায়। ডিজেলের দাম বেড়েছে, মিটার সেই একই, তাই ডিউটী টাইম ১ ঘণ্টা বাড়িয়েছে মন্টু।-‘ক্যা হুয়া ভাইসাব’ মেয়েটা গলা বাড়িয়ে জানতে চায়
-‘থোড়া ইঞ্জিন সে সাউন্ড, ম্যাডাম। আপনি বসুন। দো মিনিটে ঠিক হয়ে যাবে।‘
মন্টু বনেটটা খুলে ফেলে। ইঞ্জিন থেকে একটা গোঁ গোঁ শব্দ আজ দুপুর থেকে হচ্ছে, এখন হঠাৎ বেড়ে গিয়েছে। মন্টু ভেবেছিল কাল মেকানিককে দেখাবে। ‘শালা আবার খরচ’ গজ গজ করে মন্টু। মালিক একপয়সাও দেবে না। শব্দটা ইঞ্জিনের নীচের দিক থেকে আসছে। স্প্যানার আর যা যা আছে সব নিয়ে মন্টু হামাগুড়ি দেয় গাড়ির নীচে।
-‘আপ কা ট্যাক্সি খারাব হ্যায় ত বোলা কিউঁ নেহী পহলে’, অধৈর্য শোনায় মেয়েটিকে ।
-‘আরে ম্যাডাম। এটা মেশিন হ্যায়। থোড়া রুকিয়ে তো।‘
মেয়েটা গজগজ করতে করতে কাকে যেন ফোন করে । প্রথমে খুব চেঁচিয়ে ‘শালা ট্যাক্সিড্রাইভার’ বলে কি বলছিল, আস্তে আস্তে গলা নিবে আসে, মুখে হাসি ফুটতে থাকে । ছেলে বন্ধু নির্ঘাত । বাইপাসের আলোগুলো সব যেন নেমে আসে মেয়েটার মুখে। এবার ভাল করে দেখে মন্টু, ওর মেয়ের চেয়ে অল্প বড় বোধহয়, বাইরের নাকি কলকাতার? যা ড্রেস পরেছে , আড়চোখে দেখে মন্টু।
- ৩
-‘ট্যাক্সি’ সুগতা ডাকতেই ধীর, মন্থর গতিতে এগিয়ে আসে হলুদ আম্বাসাডর।
-‘অভিষিক্তা যাব’
-‘৫০টা টাকা বেশী দেবেন ম্যাডাম’
-‘কেন, বাইপাসে ছাড়ব, তাও বেশী কেন?’
-‘টাইম দেখেছেন ম্যাডাম?’
-‘তো? রাত ১১ হয়ে গেলে বেশী লাগবে নাকি? তোমার যদি পয়সার দরকার না থাকে তাহলে চলে যাও’
-‘ফালতু কথা কেন বলছেন, পয়সার দরকার বলেই না এত রাতে এখানে আছি, গ্যারাজ করব ভবানীপুরে, কত রাত হবে বলুন তো’
-‘তোমাদের রেট তো সেভাবেই করা থাকে। ছেড়ে দাও’ সুগতা বিরক্ত হয়ে সরে আসে। ট্যাক্সিটা গড়িয়ে এগিয়ে যায় খানিক তারপর আবার বোধহয় আটকে যায়।
সুগতা ডানদিকে তাকায়। ব্রীজ। আলোগুলো যেন জ্বলতে জ্বলতে ক্লান্ত হয়ে গেছে। কিছু মানুষ ইতস্তত ছড়িয়ে আছে ব্রীজের এদিকে, সুগতারই মত, তার অফিসের, কিংবা তার পাশের, কিংবা তারও পাশের হয়ত – বিধ্বস্ত । বিপিওর একটা গাড়ি জোরে গান চালিয়ে হুউশ করে বেরিয়ে গেল। আবার ঝিমিয়ে পড়েছে তথ্য-প্রযুক্তি ।
রাত ১১-১৫। সুগতা বাঁ-দিকে তাকিয়ে দেখে ট্যাক্সিটা এগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দূরে খানিক। ড্রাইভার খৈনী ডলছে, তাকেই দেখছে কি?
-’৫০ বেশীই দেব তবে আমায় বাড়ি অব্দি নামাতে হবে কিন্তু, ওই একটু ঢুকে’।
- ৪
-‘ওই সাব্বাস। চিকনি চামেলী’
একটা মোটর সাইকেল এসে দাঁডায় পাশে। তিনটি ছেলে, মাথায় হেলমেট নেই। গলায় চেন ঝুলছে, নকল সোনার। হাতে বিচিত্র উল্কি। একজন একটা শিখর ছিঁড়ে মুখে ঢেলে দেয় পুরো প্যাকেট।
-‘এই কি চাই এখানে’ মন্টু তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে আসে ট্যাক্সির নীচ থেকে। মেয়েটার ফোন আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মুহূর্তে সে বুঝে যায় কি হতে চলেছে, ফোনে রিডায়াল টেপে।
-‘আরে জানেমন, কাকে ফোন করছ?’ একটা ছেলে এগিয়ে এসে খপ করে ধরে ফেলে মেয়েটার হাতটা। তারপর মোবাইল ফোনটা সুইচ অফ করে ছুঁড়ে দেয় দূরে ঝোপের মধ্যে।
-‘হাম শোর মাচায়েঙ্গে’ মেয়েটা বিশ্বাস করতে চায় নিজের কথাকেই যেন।
-‘ইহা আভি কৌন আগেয়া ডারলিং’ কোন একজন বলে। মেয়েটা ওদের ভাল করে দেখে নিতে চায়। যদি পরে আইডেন্টিফাই করতে হয়, খাঁ খাঁ রাস্তা এখানে ছুটে লাভ হবে কি? মেয়েটা ভাবতে থাকে।
-‘এই শালা, ভাগ এখান থেকে। রাতের বেলা মস্তানি?’ মন্টু চেঁচিয়ে ওঠে ।
-‘কে বে, গান্ডু’ একটা ছেলে পা তুলে ভারি বুট জুতো দিয়ে লাথি মারে মন্টুর কোমরে, মন্টু পড়ে যায়।
-‘শালা, তোর কে হয় বে, এত দরদ’ একটা ছেলে এগিয়ে আসে মন্টুর দিকে।
-‘তবে রে’ মন্টু স্প্যানার টা নিয়ে চালিয়ে দেয় ছেলেটার হাঁটুতে। এমন হতে পারে ছেলেগুলো ভাবতেই পারে না। রাতের কলকাতা, স্বেচ্ছাচারী কলকাতা তারাও জানত বোধহয়।
-‘আয়, মাথার ঘিলু ফাটাব’ মন্টু মন্ডল, মেমারির মন্টু মণ্ডল উঠে দাঁড়িয়ে স্প্যানার টা মাথার ওপর ঘোরাতে থাকে । যে ছেলেটা পড়ে গিয়েছিল মাটিতে সে উঠে দাঁডানোর চেষ্টা করতেই মন্টু তার সামনে এগিয়ে আসে। অন্য আরেকজন তাড়াতাড়ি তাকে ধরে নিয়ে যায় বাইকের কাছে। ততক্ষণে প্রথম জন বাইক স্টার্ট করেছে ।
-‘শালা খানকির বাচ্ছা, তোর কেটে রেখে দেব’ বাইকটা শব্দ করে এগিয়ে যায়, খুব জোর, খুব।
- ৫
সারাদিন আজ অনেক মিটিং ছিল, কোয়ার্টার-এন্ডের প্রেশার। কাজের ক্ষেত্রে খুব সুনাম সুগতার, ভাল ছাত্রী ছিল সে, তারপর এই আই টিতে এসেও ক্রমশঃ উন্নতি করেছে। কিন্তু আর কতদিন এভাবে? ছেলে বড় হলে তাকে সময় দিতেই হবে। এখনো সমাজ মায়ের বেশী বাইরের দায়িত্ব মেনে নেবে না, মেনে নেয় না। একই প্রফেশানে থেকে কত সময় অনিমেষও যেন বোঝে না, বাইরের লোকদের আর কি বলবে সুগতা। আর নীলও কি অদ্ভূত নিয়মে শিখে যাচ্ছে যে মায়ের কাজটা বোধহয় অপশ্নাল, সে বাবাকে কোনদিন থেকে যেতে বলে না। ‘ওই কাজের মেয়েগুলো ওদের মাথায় ঢোকায়, ও নিয়ে বেশী ভাবিস না’ সুগতাকে বলেছিল সোহিনীদি, কলিগ, দুটো বাচ্চার মা, বেশ ব্যালেন্স করতে পারে, ভাবে সুগতা।
চোখ বন্ধ করে ভাবছিল সুগতা। চিন্তার কি শেষ আছে? কত টাইম হয়েছে এখন – পৌনে ১২। বাইরে তাকাতেই মাথাটা কেমন ঘুরে গেল । এ কোন রাস্তা। এতো বাইপাস নয়।
কলকাতায় ১০ বছর থেকেও সুগতা সড়গড় নয়, কিন্তু রাজারহাট থেকে সোজা বাইপাস ধরে এলেই তার বাড়ি। আর এটা সে রাস্তা নয়। তার এতক্ষণ চোখ বুজে থাকার এডভান্টেজ নিল নাকি ড্রাইভারটা ।
-‘এই কোথায় যাচ্ছ? এটা তো বাইপাস না’ গলা কেঁপে যাচ্ছে সুগতার, রাস্তা বিষয়ে তার অজ্ঞতা বেশী বুঝতে দেওয়া উচিত না বোঝে সুগতা।
-‘কি হ’ল? এদিকে কোথায় যাচ্ছ?’ সুগতার গলাটা ধরে আসে ক্রমশঃ ।
- ৬
-‘ম্যাডাম, উঠে পড়ুন’ মন্টু বলে মেয়েটাকে। মেয়েটা একটা ব্ল্যাঙ্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মন্টুর দিকে।
-‘মেরা মোবাইল?’ সম্বিত ফিরে পায় যেন
-‘আরে ছোড়িয়ে, কোথায় ফেলেছে। তাড়াতাড়ি যানা হোগা। ও লোগ, ফির আসতে পারে’ মন্টু স্টিয়ারিং-এ বসে, ইঞ্জিনের শব্দ মাথায় উঠেছে। আগে তো একে নামিয়ে গ্যারেজে পৌঁছনো যাক।
রাতে তো পুলিশ কম। টহলদার পুলিশ আছে কিন্তু তারা হয়ত সবে পাস করেছে। জানলার কাঁচগুলো তুলে দেয় মন্টু, ভরসা নেই যদি আবার কোন হামলা হয়। মেয়েটা পেছনের সীটে বসে এতক্ষণে কান্না শুরু করে দিয়েছে। কোথায় একটু কথা বলবে, তা না। মন্টুর নিজের ও কি আর বুক ঢিপঢিপ করছে না? যদি ছেলেগুলর কাছে পিস্তল থাকতো, আজকাল তো হামেশাই শোনা যায় এসব। ডাণ্ডা থাকলেও তো মাথায় বসিয়ে দিতে পারত, হয়ে যেত তাহলে। না, কাজটা উচিত হয়নি মন্টু বুঝতে পারে। ঝামেলায় না গিয়ে কেটে পড়া উচিত ছিল । মেয়েটার কান্না বেড়েই চলেছে।
-‘আপ কিসিকো ফোন করবেন? হামারা মোবাইল সে কিজিয়ে’ মন্টু ভাবে যদি এভাবে কান্নাটা থামে। মেয়েটা মোবাইল থেকে কাকে ফোন করে। কান্না আরো বেড়ে যায় তার। হয়ত সেই বন্ধুটা যাকে আগের বার করেছিল, কে জানে?
সিগনালটা পেরোতেই রিয়ার ভিউতে মন্টু দেখে সেই বাইকটা। নির্ঘাত ঘাপটি মেরে ছিল কোথাও। ২ ছেলের হাতে রডের মত কিছু কি? ক্রমশঃ দুরত্ব কমে আসছে, মন্টু কি করবে বুঝতে পারে না, একদম পাশে প্রায় এসে গিয়েছে বাইকটা। মন্টু জানে ওদের প্রথম শিকার এখন ও নিজে, তারপর ওরা মেয়েটাকে নিয়ে ভাববে।
- ৭
-‘আরে চুপ করুন না, ঠিক পৌঁছে দেব আপনাকে’
-‘ভাবছ আমি কিছু রাস্তা জানি না? বেশী ঘুরিয়ে মিটারে বেশী তুলতে চাও? এইসব মতলব?’
-‘আরে মুশকিল আছে, বল্লাম তো বাড়িতেই নামাব’ ড্রাইভারটা বার বার আয়না দিয়ে দেখছে, তাকেই দেখছে নিশ্চয়, হা ভগবান, সুগতা মাথায় হাত দেয়।
হু হু করে ট্যাক্সিটা ছুটছে, বাইরে বন্ধ দোকানের একটায় চোখে পড়ে তোপ্সিয়া কথাটা।
কিছুদিন আগেই একটা মেয়েকে এখানেই কোথাও ফেলে রেখেছিল, বিপিও-র মেয়ে। কাগজে দেখেছিল তখন, তোপ্সিয়া কোথায় জানত না সুগতা। আজ সেখানেই সে যাচ্ছে। মাথাটা কেমন বোঁ বোঁ করছে।
-‘কত টাকা লাগে তোমার, আমি দেব। আমাকে ছেড়ে দাও’ সুগতা আর সামলাতে পারে না।
-‘আরে কি মুশকিল দেখছি। কাঁদছেন কেন? বাড়ি তো পৌঁছে দেব বলেছি’ আবার ও কি ওকে দেখছে লোকটা, ভাবে সুগতা।
-‘না, আমি এখনই বাড়ি যাব। আমার ছেলের জন্মদিন। প্লিজ আমায় ছেড়ে দিন’ সুগতা হাত জোড় করে সীটের পেছন থেকে ড্রাইভারের পীঠে রাখে।
ড্রাইভার বিরক্ত হয় বোঝা যায় কোন কথা বলে না, স্পীড বাড়াতে থাকে ট্যাক্সির।
সুগতা কাঁপতে থাকে। ফোন করলে লোকটা বুঝে যাবে। সে কাঁপা কাঁপা হাতে অনিমেষকে টেক্সট করতে থাকে।
-‘গাড়ির নম্বর কত? আ-আমার লাগবে’ সুগতা ঢোক গেলে।
-‘তাই দিয়ে আপনি কি করবেন দিদি? তার চেয়ে চুপ করে সেঁটে থাকুন আমি আপনাকে বাড়ি নিয়ে যাব। একটু ঘুরতে হল কিন্তু সোজা যাওয়া যেত না’
-‘কেন যেত না, শুনি? আমায় নামিয়ে দিন’ সুগতা একটু জোর আনতে চায়। শব্দ করে ফোন টা বেজে উঠছে, অনিমেষ করছে কিন্তু সুগতা এখন ধরতে পারবে না, লোকটা সব শুনবে তাহলে। কেটে দেয়। অনিমেষ আবার করে, আবার, আবার। সুগতার রাগ হতে থাকে। আবার টেক্সট করে, অনিমেষ উত্তর দেয় ‘নীল ওয়েট করে করে এই ঘুমোতে গেল। তুমি পারলে না’ । সুগতা কাঁদতে থাকল অভিমানে । অনিমেষ এখনো বোঝেনি কি পরিস্থিতিতে সে আছে। বোঝার চেষ্টা ও করেছে কি, খোঁটা দেওয়া টেক্সট করা ছাড়া, জানতে চায়নি ঠিক কি হচ্ছে, এখন কোথায় সুগতা। ছেলেকেও নিশ্চয় তার বিরুদ্ধে কিছু বলেছে। সুগতা ব্যাগের ভেতর থেকে দুটো গাড়ি আস্তে আস্তে বের করে আনে।
- ৮
ঘাড় ঘোরাতেই মন্টু দেখে দুটো ছেলেই হাত তুলেছে ট্যাক্সির কাঁচ লক্ষ্য করে। আচমকা ফুল ব্রেক মারে মন্টু। পেছনের মেয়েটা দড়াম করে সামনের সীটে ধাক্কা খায়। বাইকটা এটা আশা করেনি। স্পীডের ওপর দুজনের মারা চেষ্টার ইনারশিয়ায় বোধহয় টাল সামলাতে না পেরে বেশ কিছুটা দূরে লগবগ করতে বাইকটা পড়ে গেল। ছেলে তিনটে উঠে গা ঝাড়া দিয়ে বাইকটা সোজা করতে না করতেই একটা ট্যাক্সি খুব জোরে ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে গেল। দুটো ছেলে ছিটকে পড়ল বাইপাসের পাশে যে খোঁড়া হচ্ছে সেখানে, অন্যটার লাগেনি বিশেষ । আরও কিছুটা দূরের মেট্রোর কাজ হচ্ছে যেখানে সেখানের কিছু লেবার কর্মী আওয়াজে ছুটে বেরিয়ে এসেছে
-‘রোজ এই রাতের বেলায় আক্সিডেন্ট’ বলে ওঠে একজন
-‘সব মদ খেয়ে ট্রাকগুলান চালায়, রাতটায় রাস্তা যেন ওদের’ আরেকটা গলা ভেসে আসে
-‘আরে ট্যাক্সি ছিল তো, ট্রাক না’
-‘ওই ট্রাকড্রাইভার ট্যাক্সি চালাচ্ছে শালারা’
-‘মরেনি রে’
ভিড়টা আবার পাতলা হতে শুরু করে। রাতের আক্সিডেন্টে না মরলে উত্তাপ নেই এই শীতের রাতে।
- ৯
মাথার ওপর হাত তুলে সুগতা দুটো গাড়ী দিয়ে মারতে যায় ড্রাইভারকে।
-‘তখন থেকে কি নকশা করছেন বলুন তো’ ড্রাইভার ঘুরে গিয়ে একটা থাপ্পড় মারতে যায় সুগতাকে। তার হাতের গাড়ি গুলো নিয়ে ফেলে দেয় জানলা দিয়ে।
-‘আর কি আছে অস্ত্র আপনার? বার করুন, করুন’ ধমকে ওঠে ড্রাইভার। হিক্কা তুলতে থাকে সুগতা, তার গলা শুকিয়ে যায়, কথা বেরোয় না।
-‘দেখছেন না তখন থেকে একটা বাইক আমাদের ধাওয়া করছে। আমি তাই এমন এদিক অদিক দিয়ে চলেছি, যাতে ফলো না করতে পারে। তার মধ্যে আপনি শালা সেই তখন থেকে টিকির টিকির’ এক নিঃশ্বাসে বলে ড্রাইভার।
-‘কোথায় বাইক? কিছুই তো নেই পেছনে’ সুগতা উঠে বসার চেষ্টা করে।
-‘হুঁহ নেই! বল্লেই হবে? প্রতিদিন রাত ১১ র পর হলেই ফলো করে বাইপাসে। আমি তাই এদিকে আসতে চাই না’ ড্রাইভার বলে চলে।
-‘না না, সত্যি নেই, তুমি ভাল করে দেখ’, একটু জল খেয়ে সুগতা আবার ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’ তে চলে আসে।
-‘আমি কি আপনার থেকে বেশি পয়সা চেয়েছিলাম? ঘুরে যাচ্ছি বলে? তবু আপনি এত ঝামেলা করছেন। এই কারণে রাতে মেয়েছেলে তুলতে নেই গাড়িতে। আমার শালা জোটেও’
সুগতা কোন কথা বলে না, বাইরে আবার বাইপাসের বড় বড় ফ্ল্যাট বাড়ি গুলো দেখা যাচ্ছে, রুবী মোড় বোধহয় কাছেই কোথাও, তার বাড়িও কাছেই তবে, রুবী থেকে তো ঘুরেই । ঘড়িতে ১২-৩০। অনিমেষ খেয়েছে কি? নীল ঘুমোচ্ছে নিশ্চিন্তে, অরণ্যদেবের সাথে তার খেলার কথা ভেবে ঘুমের ঘোরেই হেসে উঠছে বোধহয়। কাল সকালে ওর জন্য গাড়ি কিনে আনবে সুগতা – হলুদ ট্যাক্সি । আর অনেকদিন পর কাল ছুটি নেবে সে।
Fiction